Header Ads

Header ADS

মহামারীতে শাহাদাত বরণকারী মুসলমানদের এক আমীর - আবু উবাইদা।

মহামারীতে শাহাদাত বরণকারী মুসলমানদের এক আমীর - আবু উবাইদা।

রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ প্রত্যেক জাতিরই একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি আছে। আর এ মুসলিম জাতির পরম বিশ্বাসী ব্যক্তি আবু উবাইদা।’

তিনি ছিলেন উজ্জ্বল মুখমণ্ডল, হালকা পাতলা গড়ন ও দীর্ঘদেহের অধিকারী। তাঁকে দেখলে যে কোন ব্যক্তির চোখ জুড়িয়ে যেত, সাক্ষাতে অন্তরে ভক্তি ও ভালোবাসার উদয় হত এবং হৃদয়ে একটা নির্ভরতার ভাব সৃষ্টি হত। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধাবী, অত্যন্ত বিনয়ী ও লাজুক প্রকৃতির। তবে যে কোন সংকট মুহূর্তে সিংহের ন্যায় চারিত্রিক দৃঢ়তা তাঁর মধ্যে ফুটে উঠত। তাঁর চারিত্রিক দীপ্তি ও তীক্ষ্ণতা ছিল তরবারীর ধারের ন্যায়। রাসূলের সা. ভাষায় তিনি ছিলেন উম্মাতে মুহাম্মাদীর ‘আমীন’- বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।


ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু যখন সিরিয়া সফরে যান তখন মনে মনে ভাবলেন মুসলমান ভাইদের অবস্থাও ঘুরে দেখবেন। তাই প্রসঙ্গক্রমে একদিন হযরত উবাইদা (রা:) কে বললেন আমার মন চায় আপনার ঘর দেখব। হযরত ওমর হয়তো ভেবেছিলেন হযরত উবাইদা মদিনা থেকে এসেছেন, সিরিয়ার গভর্নর হয়েছেন, মদিনা হলো সাদামাটা কৃষি অঞ্চল। চোখধাঁধানো উৎপাদন ও শিল্প সৌন্দর্য সেখানে নেই। পক্ষান্তরে সিরিয়া যেমন সবুজ ফসলের অঞ্চল, তেমনি রোমক সভ্যতা সজ্জিত এক উন্নত নগর। এখানে আসার পর উবায়দা এর ভিতরে দুনিয়ার কোন আকর্ষণ সৃষ্টি করলো কি-না যে আকর্ষণে হয়তো তিনি আলিশান কোন এক বাড়ি বানিয়েছেন - যে বাড়িতে হয়তো এখন তিনি শান শওকতের সাথে অবস্থান করছেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর অন্তরে এমন কোনো সংশয় হয়তো সৃষ্টি হয়েছিল। তাই তিনি হযরত আবু ওবায়দা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কে বললেন আমার মন চাচ্ছে আপনার ঘরে একবার যাব। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বললেন, আমিরুল মুমিনিন! আমার ঘরে আপনি কি করবেন? আমার ঘর দেখলে হয়তো কিছু অশ্রু বিসর্জন ছাড়া আর কোন লাভই আপনার হবেনা। হযরত ওমর বললেন তবুও আমার মন চাচ্ছে আমি আমার ভাইয়ের ঘর প্রদর্শন করব।

অবশেষে একদিন হযরত ওবায়দা হযরত ওমরকে সঙ্গে করে রওনা হলেন। দুজন একসাথে চলছেন তো চলছেনই। কথাও ঘরবাড়ি কিছুই নজরে পড়ছে না। যখন শহর প্রায় শেষ, শহরের শেষ সীমানা পেরিয়ে খোলা ময়দানে নেমেছেন, তখন হযরত ওমর জিজ্ঞেস করলেন ভাই আমি তোমার ঘর দেখতে চেয়েছিলাম তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে চলেছ? ওবায়দা বললেন আমিরুল মুমিনিন আমিতো আপনাকে আমার ঘরেই নিয়ে যাচ্ছি‌। হাঁটতে হাঁটতে জনবসতির বাইরে ঘাসের তৈরি একটি ঝুপড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন - হযরত উবাইদা ইবনে জাররাহ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু, সিরিয়ার গভর্নর। বললেন, আমিরুল মুমিনিন! এটাই আমার ঘর! হযরত ওমর ফারুক ঝুপড়ির ভেতর প্রবেশ করলেন। চার দিকে দৃষ্টি বোলালেন, কোন বস্তু নজরে পড়ল না। শুধু একটি মুসল্লা বিছানো আছে। মুসল্লা ছাড়া ব্যবহারের অন্য কোনো সামগ্রী নেই। জিজ্ঞেস করলেন, ওবায়দা তুমি এখানে কিভাবে জীবিত থাকো? তোমার আসবাবপত্র কোথায়? হযরত উবাইদা একটু সামনে অগ্রসর হলেন এবং একটি তাক থেকে একটি পেয়ালা বের করে আনলেন। সে পেয়ালায় কিছু পানি ছিল আর পানির মধ্যে কয়েক টুকরো রুটি ভেজানো ছিল। ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু নয়নভরে দেখলেন। হযরত উবাইদা আরজ করলেন, আমীরুল মুমিনীন! আমার যে দায়িত্ব সে দায়িত্ব আদায় করার পর খাবার রান্না করার সময় তো আমি পাইনা, তাই আমি পূর্ণ এক সপ্তাহের রুটি এক মহিলাকে দিয়ে তৈরি করিয়ে নেই। সে মহিলা এক সপ্তাহের রুটি রান্না করে আমাকে দিয়ে যায়। যখন ক্ষুধা পায় তখন সেই রুটি এই পানিতে ভিজিয়ে খেয়ে নেই। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তাআলার মেহেরবানীতে জীবন ভালই কেটে যাচ্ছে। হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বললেন তোমার আর সমানপত্র কোথায়? ওবাইদা বললেন আমিরুল মুমিনীন আর সামান দিয়ে কি করবো? কবর পর্যন্ত পৌঁছতে তো এতটুকুই যথেষ্ট! এই দৃশ্য দেখে হযরত ওমর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। বললেন, এই পৃথিবীর রাজত্ব আর নেতৃত্ব আমাদের সকলকে বদলে দিয়েছে। কিন্তু খোদার কসম তুমি হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কালে যেমন ছিলে এখনো তেমনি রয়ে গেছো। হযরত উবাইদা বললেন, আমিরুল মোমেনীন! আমি পূর্বেই বলেছিলাম, আমার ঘরে এলে আপনি কিছু চোখের পানি বিসর্জন দেয়া ছাড়া আর কোন লাভই হবেনা!

এই হল সিরিয়ার এক মহান গভর্নরের জীবন!

একসময় সিরিয়ায় মহামারী আকারে প্লেগ দেখা দেয়। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে লাগলো। খলীফা হযরত উমার রা. নিজেই খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য রাজধানী মদীনা থেকে ‘সারগ’ নামক স্থানে পৌঁছুলেন। অন্য নেতৃবৃন্দের সাথে আবু উবাইদা সেখানে খলীফাকে অভ্যর্থনা জানালেন। প্রবীণ মুহাজির ও আনসারদের সাথে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করলেন। সবাই একবাক্যে সেনাবাহিনীর সদস্যদের স্থান ত্যাগের পক্ষে মত দিলেন। হযরত উমার সবাইকে আহ্‌বান জানালেন তাঁর সাথে আগামী কাল মদীনায় ফিরে যাওয়ার জন্য। তাকদীরের প্রতি গভীর বিশ্বাসী আবু উবাইদা বেঁকে বসলেন। খলীফাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘আ ফিরারুম মিন কাদলিল্লাহ- একি আল্লাহর তাকদীর থেকে পলায়ন নয়?’ খলীফা দুঃখ প্রকাশ করে বললেনঃ ‘আফসুস! আপনি ছাড়া কথাটি অন্য কেউ যদি বলতো! হাঁ, আল্লাহর তাকদীর থেকে পালাচ্ছি। তবে অন্য এক তাকদীরের দিকে। আবু উবাইদা তাঁর বাহিনীসহ সেখানে থেকে গেলেন। খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমার মদীনা পৌঁছে দূত মারফত আবু উবাইদাকে একখানা পত্র পাঠান। পত্রে তিনি লিখেনঃ ‘‘আপনাকে আমার খুবই প্রয়োজন। অত্যন্ত জরুরীভাবে আপনাকে আমি তলব করছি। আমার এ পত্রখানি যদি রাতের বেলা আপনার কাছে পৌঁছে তাহলে সকাল হওয়ার পূর্বেই রওয়ানা দেবেন। আর যদি দিনের বেলা পৌঁছে তাহলে সন্ধ্যার পূর্বেই রওয়ানা দেবেন।’’ খলীফা উমারের এ পত্রখানি হাতে পেয়ে তিনি মন্তব্য করেনঃ ‘আমার কাছে আমীরুল মুমিনীনের প্রয়োজনটা কি তা আমি বুঝেছি। যে বেঁচে নেই তাকে তিনি বাঁচাতে চান। তারপর তিনি লিখলেনঃ ‘‘আমীরুল মু’মিনীন, আমি আপনার প্রয়োজনটা বুঝেছি। আমি তো মুসলিম মুজাহিদদের মাঝে অবস্থান করছি। তাদের ওপর যে ‍মুসিবাত আপতিত হয়েছে তা থেকে তাদেরকে ছেড়ে আমি নিজেকে বাঁচানোর প্রত্যাশী নই। আমি তাদেরকে ছেড়ে যেতে চাইনা, যতক্ষণ না আল্লাহ আমার ও তাদের মাঝে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেন। আমার এ পত্রখানি আপনার হাতে পৌঁছার পর আপনি আপনার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন এবং আমাকে এখানে অবস্থানের অনুমতি দান করুন।’’

হযরত উমার এ পত্রখানি পাঠ করে এত ব্যাকুলভাবে কেঁদেছিলেন যে, তাঁর দু’চোখ থেকে ঝর ঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর এ কান্না দেখে তার আশেপাশের লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলঃ ‘আমীরুল মু’মিনীন, আবু উবাইদা কি ইনতিকাল করেছেন?’ তিনি বলেছিলেনঃ ‘না। তবে তিনি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।’

হযরত উমারের ধারণা মিথ্যা হয়নি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্লেগে আক্রান্ত হন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তিনি তাঁর সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে উপদেশমূলক একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেন। তিনি বলেনঃ ‘‘তোমাদেরকে যে উপদেশটি আমি দিচ্ছি তোমরা যদি তা মেনে চলো তাহলে সবসময় কল্যাণের পথেই থাকবে। তোমরা নামায কায়েম করবে, রমাদান মাসে রোযা রাখবে, যাকাত দান করবে, হজ্জ ও উমরা আদায় করবে, একে অপরকে উপদেশ দেবে, তোমাদের শাসক ও নেতৃবৃন্দকে সত্য ও ন্যায়ের কথা বলবে, তাদের কাছে কিছু গোপন রাখবে না এবং দুনিয়ার সুখ সম্পদে গা ভাসিয়ে দেবে না। কোন ব্যক্তি যদি হাজার বছরও জীবন লাভ করে, আজ আমার পরিণতি তোমরা দেখতে পাচ্ছ - তারও এই একই পরিণতি হবে।’’

সকলকে সালাম জানিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন। অতঃপর মুয়াজ ইবন জাবালের দিকে তাকিয়ে বলেনঃ ‘মুয়াজ! ‍তুমি নামাযের ইমামতি কর।’ এর পরপরই তাঁর রূহটি পবিত্র দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরম সত্তার দিকে ধাবিত হয়। মুয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে সমবেত সকলকে লক্ষ্য করে বলেনঃ লোক সকল! তোমরা এ ব্যক্তির তিরোধানে ব্যথা ভারাক্রান্ত। আল্লাহর কসম! আমি এ ব্যক্তির থেকে অধিক কল্যাণদৃপ্ত বক্ষ, পরিচ্ছন্ন হৃদয়, পরকালের প্রেমিক এবং জনগণের উপদেশ দানকারী আর কোন ব্যক্তিকে জানিনা। তোমরা তাঁর প্রতি রহম কর, আল্লাহও তোমাদের প্রতি রহম করবেন।

এই হল আবু উবাইদা - আপনাদেরই এক পূর্বপুরুষ, এক নেতা। যুদ্ধের ময়দানে ঈমানের দৃঢ়তায় বলীয়ান আবু উবাইদা (যা:) নিজের পিতাকে হত্যা করার পর আল্লাহ তা’আলা যার শানে নিম্নের এ আয়াতটি নাযিল করেন:

‘তোমরা কখনো এমনটি দেখতে পাবে না যে, আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার লোকেরা কখনো তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সা. বিরুদ্ধাচরণ করেছে- তারা তাদের পিতা-ই হোক কিংবা তাদের পুত্র-ই হোক বা ভাই হোক অথবা তাদের বংশ-পরিবারের লোক। তারা সেই লোক যাদের দিলে আল্লাহ তা’আলা ঈমান দৃঢ়মূল করে দিয়েছেন এবং নিজের তরফ হতে একটা রূহ দান করে তাদেরকে এমন সব জান্নাতে দাখিল করবেন যার নিম্নদেশে ঝর্ণাধারা প্রবহমান হবে। তাতে তারা চিরদিন থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও সন্তুষ্ট হয়েছেন তাঁর প্রতি। এরা আল্লাহর দলের লোক। জেনে রাখ, আল্লাহর দলের লোকেরাই কল্যাণপ্রাপ্ত হবে।’ (আল মুজাদিলা- ২২)।

হে আল্লাহ! আমাদেরকেও আপনি আপনার দলের লোক বানিয়ে নিন ,আর কল্যাণপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। আমীন!!

No comments

Powered by Blogger.