রজব মাস: এ সব বিদ’আত দূর হওয়া আবশ্যক
১) ভূমিকা
২) রজব মাসকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন ইবাদত করার কথা কি হাদীসে বর্ণিত হয়েছ?
৩) রজব মাস সম্পর্কে কয়েকটি দুর্বল হাদীস।
৪) রজব মাস সম্পর্কে কয়েকটি জাল হাদীস।
৫) রজব মাসকে কেন্দ্র করে নামায, রোযা, ইতিকাফ ইত্যাদি ইবাদত করা।
৬) সালাতুর রাগায়েব এর বিদআত।
৭) শবে মেরাজ পালন করার বিদআত।
তাহলে আসুন, আমরা ধারাবাহিকভাবে উক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে আলোচনায় প্রবৃত্ত হই।
১) ভূমিকা
সম্মানিত পাঠক, আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য দিয়েছেন মহা গ্রন্থ আল কুরআনুল কারীম এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ। তাই বিদাআতীর বিদআত অনুসরণ করার প্রতি আমরা মুখাপেক্ষী নই। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:
“তোমরা অনুসরণ কর, যা তোমাদের প্রতি পালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য সাথীদের অনুসরণ করো না। (সূরা আরাফ: ৩)
আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের যাবতীয় বিধানকে দিবালোকের মত সুস্পষ্টভাবে আমাদের জন্য বর্ণনা করে দিয়েছন। তিনি মুসলিম উম্মাহর নিকট আল্লাহর সত্য বাণীকে পৌঁছে দিতে সামান্যতম কার্পণ্য করেন নি। সাহাবীগণ ও সত্যকে মনে-প্রাণে ও বাস্তব জীবনে এ সত্যের সাক্ষ্য দিয়ে চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করেছেন। এই পথ থেকে শুধু হতভাগ্যরাই বিচ্যুত হয়। তাই আমাদের কর্তব্য কুরআন-সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা এবং সকল ধরণের বিদআত থেকে দূরে থাকা।
সম্মানিত পাঠক, আমরা দেখি রজব মাসকে কেন্দ্র করে অনেক মুসলমান এমন অনেক কার্যক্রমে লিপ্ত হয় যার ব্যাপারে কুরআন-সু্ন্নাহর বিশুদ্ধ কোন প্রমাণ নেই। যেমন, রজব মাসকে কেন্দ্র করে বিশেষভাবে কিছু রোযা রাখা, ইবাদত-বন্দেগী করা, রজবী উমরা পালন করা, মেরাজ দিবস কিংবা শবে মেরাজ পালন করা ইত্যাদি। তাছাড়া রজব মাসের ফযিলতে এমন অনেক হাদীস পেশ করা হয় যেগুলো হাদীস বিশারদগণের দৃষ্টিতে হয় দুর্বল না হয় বানোয়াট।
২) রজব মাসকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন ইবাদত করার কথা কি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে?
ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন:
“রজব মাসের মর্যাদার ব্যাপারে অথবা রজব মাসে বিশেষভাবে কোন ধরণের নফল নামায-রোযা কিংবা এর কোন নির্দিষ্ট রাতে ইবাদত-বন্দেগী করার ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য কোন হাদীস বর্ণিত হয় নি। আমার আগে এ কথাটি ইমাম হাফেয আবু ইসমাইল আল হারাবী দৃঢ়তা সহকারে বলেছেন। আমি এ কথা তার নিকট থেকে এবং আরও অন্যান্য মনিষীদের নিকট থেকে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছি।” (তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী ফাযলি রাজাব)
এর পর তিনি এ প্রসঙ্গে বর্ণিত বেশ কিছু যঈফ ও জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন। নিন্মে অতি সংক্ষেপে সেগুলো থেকে কয়েকটি হাদীস পেশ করব ইনশাআল্লাহ।
৩) রজব মাস সম্পর্কে কয়েকটি দুর্বল হাদীস:
১) “জান্নাতে একটি নহর আছে যাকে বলা হয় রজব। যার পানি দুধের চেয়ে সাদা, মধুর চেয়েও মিষ্টি। যে ব্যক্তি রজব মাসে একদিন রোযা রাখবে তাকে সেই নহরের পানি পান করতে দেয়া হবে।”
ইবনে হাজার রহ. বলেন: হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, আবুল কাসেম আত তাইমী তার আত তারগীব ওয়াত তারহীব কিতাবে, হাফেয আসপাহানী ফাযলুস সিয়াম কিতাবে, বাইহাকী, ফাযায়েলুল আওকাত কিতাবে, ইবনু শাহীন আত তারগীব ওয়াত তারহীব কিতাবে।
এ হাদীসটি দুর্বল। ইবনুল জাওযী ইলালুল মুতানাহিয়া গ্রন্থে বলেন: এ হাদীসের বর্ণনা সূত্রে একাধিক অজ্ঞাত রাবী রয়েছে। তাই এ হাদীসের সনদ দুর্বল। তবে বানোয়াট বলার মত পরিস্থিতি নেই। এর আরও কয়েকটি সূত্র রয়েছে কিন্তু সেগুলোতেও একাধিক অজ্ঞাত বর্ণনাকারী রয়েছে। [দ্রষ্টব্য: তাবয়ীনুল আজাব (পৃষ্ঠা নং ৯, ১০ ও ১১), আল ইলালুল মুতানাহিয়া, (২য় খণ্ড, ৬৫ পৃষ্ঠা)।]
২) “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাবা ওয়া শাবানা ও বাল্লিগনা রামাযান।”
“হে আল্লাহ তুমি রজব ও শাবানে আমাদেরকে বরকত দাও। আর আমাদেরকে রামাযান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও।” (মুসনাদ আহমাদ ১/২৫৯)
হাদীসটি দুর্বল।
এ হাদীসের সনদে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে যার নাম যায়েদাহ বিন আবুর রিকাদ। তার ব্যাপারে ইমাম বুখারী রহ. বলেন: মুনকারুল হাদীস। ইমাম নাসাঈ তার সুনান গ্রন্থে তার নিকট থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করার পর বলেন: চিনি না এই ব্যক্তি কে? আর তিনি তার যুয়াফা কিতাবে বলেন: মুনকারুল হাদীস। কুনা গ্রন্থে বলেন: “তিনি নির্ভরযোগ্য নন। ইবনে হিব্বান বলেন: তার বর্ণিত কোন হাদীসকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। দ্রষ্টব্য: তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী ফযলি রাজাব, ১২ পৃষ্ঠা। আয যুয়াফাউল কাবীর (২/৮১) তাহযীবুত তাহযীব (৩/৩০)
৩) “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযানের পরে রজব ও শাবান ছাড়া অন্য কোন মাসে রোযা রাখেন নি।” (বাইহাকী)
হাফেয ইবনে হাজার বলেন: উক্ত হাদীসটি মুনকার। কারণে, এর সনদের ইউসুফ বিন আতিয়া নামক একজন রাবী রয়েছে। সে খুব দূর্বল। (তাবয়ীনুল আজাব ১২ পৃষ্ঠা)
৪) রজব মাস সম্পর্কে কয়েকটি জাল হাদীস:
১) রজব আল্লাহর মাস, শাবান আমার মাস এবং রামাযান আমার উম্মতের মাস।”
এটি জাল হাদীস।
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, উক্ত হাদীসটি বর্ণনাকারীদের মধ্যে আবু বকর আন নাক্কাশ নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে। সে কুরআনের মুফাসসির। কিন্তু লোকটি জাল হাদীস রচনাকারী এবং চরম মিথ্যাবাদী দাজ্জাল। ইবনে দেহিয়া বলেন: এই হাদীসটি জাল। (তাবয়ীনুল আজব, ১৩-১৫ পৃষ্ঠা) এছাড়াও উক্ত হাদীসকে জাল বলে চিহ্নিত করেছেন ইবনু জাওযী তার আল মাওযূয়াত কিতাবে (২/২০৫-২০৬) এবং ইমাম সানয়ানী মাওযূআত কিতাবে (৬১ পৃষ্ঠা) এবং সূয়ূতী তার আল লাআলী আল মাসনূআহ কিতাবে (২/১১৪)।
২) কুরআনের মর্যাদা সকল যিকির-আযকারের উপর যেমন রজব মাসের মর্যাদা অন্যান্য মাসের উপর তেমন।”
হাদীসটি বানোয়াট।
ইবনে হাজার আসকালানী উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করার পর বলেন, এই হাদীসটি সনদের রাবীগণ সবাই নির্ভরযোগ্য একজন ছাড়া। তার নাম হল, সিকতী। আর এ লোকটিই হল বিপদ। কেননা, সে একজন বিখ্যাত জাল হাদীস রচনাকারী। (তাবয়ীনুল আজাব: ১৭ পৃষ্ঠা)
৪) রজব মাসে যে ব্যক্তি তিনটি রোযা রাখবে আল্লাহ তায়ালা তার আমলনামায় একমাস রোযা রাখার সওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন, আর যে ব্যক্তি সাতটি রোযা রাখবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জাহান্নামের সাতটি দরজা বন্ধ করে দিবেন।”
হাদীসটি জাল।
এটিকে জাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ইবনু জাওযী আল মাওযূয়াত কিতাবে (২/২০৬), সূয়ূতী আল লাআলী আল মাসনূআহ কিতাবে (২/১১৫), শাওকানী আল ফাওয়ায়েদুল মাজমুয়াহ কিতাবে (১০০ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ২২৮) এবং তাবয়ীনুল আজাব কিতাবে (১৮ পৃষ্ঠা)।
৫) “যে ব্যক্তি রজবের প্রথম তারিখে মাগরিব নামায আদায় করত: বিশ রাকায়াত নামায পড়বে, প্রতি রাকায়াতে সূরা ফাতিহা এবং সূরা ইখলাস একবার করে পড়বে এবং প্রতি দু রাকায়াত পরপর সালাম ফিরিয়ে মোট দশ সালামে বিশ রাকায়াত পূর্ণ করবে তোমরা কি জানেন তার সওয়াব কি?…তিনি বলেন: আল্লাহ তায়ালা তাকে হেফাজত করবেন এবং তার পরিবার, সম্পত্তি ও সন্তান-সন্ততীকে হেফাজত করবেন, কবরের আযাব থেকে রক্ষা করবেন এবং বিনা হিসেব ও বিনা শাস্তিতে বিদ্যুৎ গতিতে পুলসিরাত পার করাবেন।”
এটি একটি বানোয়াট হাদীস।
(দ্রষ্টব্য: ইবনুল জাউযী তার মাওযূয়াত (২/১২৩), তাবয়ীনুল আজাব (২০ পৃষ্ঠা), আল ফাওয়াইদুল মাজমূয়াহ (৪৭পৃষ্ঠা, জাল হাদীস নং ১৪৪)।)
৫) “যে ব্যক্তি রজব মাসে রোযা রাখবে এবং চার রাকায়াত নামায পড়বে সে জান্নাতে তার নির্ধারিত আসন না দেখে মৃত্যু বরণ করবে না।”
হাদীসটিকে জাল বলে আখ্যায়িত করেছেন ইবনু জাওযী আল মাওযূয়াত কিতাবে (২/১২৪), শাওকানী আল ফাওয়ায়েদুল মাজমুয়াহ কিতাবে (৪৭ পৃষ্ঠা) এবং তাবয়ীনুল আজাব, (২১ পৃষ্ঠা)।
৬) সালাতুর রাগায়েব নামায সম্পর্কিত হাদীস। হাদীসটি হল:
”রজবের প্রথম শুক্রবার রাতটি ব্যাপারে তোমরা গাফলতি কর না। কারণ, ফেরেশতাগণ এ রাতটিকে রাগায়েব বলে আবিহিত করেন। এ রাতে শেষভাগে আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত এমন কোন ফেরেশতা বাকি থাকে না যারা কাবা শরীফ এবং তার চারপাশে এসে একত্রিত না হয়। তারপর আল্লাহ তায়ালা তাকিয়ে দেখে ফেরেশতাদেরকে বলেন, হে আমার ফেরেশতাগণ, তোমরা যা খুশি আমার নিকট চাও। তারা বলেন: হে আল্লাহ তোমার নিকট দরখাস্ত পেশ করছি যে, যে সকল লোক রজব মাসে রোযা রাখে তাদেরকে ক্ষমা করে দাও। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ঠিক আছে, তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। অত:পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি রজব মাসের প্রথম বৃহ:পতিবার দিনে রোযা রাখবে এবং শুক্রবার রাতে মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে বার রাকায়াত নামায পড়বে…।”
এ হাদীসটি জাল।
দেখুন: ইবনুল জাওযী রচিত আল মাওযূয়াত ২/১২৪-১২৬, তাবয়ীনুল আজাব (২২-২৪পৃষ্ঠা), আল ফাওয়ায়েদুল মাজমূয়া, (৪৭-৫০ পৃষ্ঠা, জাল হাদীস নং ১৪৬)
৭) নিশ্চয় রজব একটি মহান মাস। যে ব্যক্তি এ মাসের কোন একদিন রোযা রাখবে আল্লাহ তায়ালা এর বিনিময়ে তার আমল নামায় এক হাজার বছরের সওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন।”
হাদীসটি জাল।
এ হাদীসটিকে জাল বলে আখ্যায়িত করেছেন ইবনু জাওযী আল মাওযূয়াত কিতাবে (২/২০৬-২০৭), সূয়ূতী আল লাআলী আল মাসনূআহ কিতাবে (২/১১৫), শাওকানী আল ফাওয়ায়েদুল মাজমুয়াহ কিতাবে (১০১ পৃষ্ঠা, জাল হাদীস নং ১৪৫) এবং তাবয়ীনুল আজাব, (২৬ পৃষ্ঠা)।
রজব মাস সম্পর্কে এখানে মাত্র কয়েকটি প্রচলিত জাল হাদীস উপস্থাপন করা হল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এমন আরও বহু জাল হাদীস বিভিন্ন কিতাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উদ্দেশ্য এটা দেখানো যে, রজব মাসে বিশেষ নামায, রোযা ও ইবাদত-বন্দেগী নাই। বরং এ প্রসঙ্গে অনেক বানোয়াট ফযীলতের কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক পথে সন্ধান দান করুন। আমীন।
৫) রজব মাসকে কেন্দ্র করে নামায, রোযা, ইতিকাফ, ইত্যাদি ইবাদত করা।
রজব মাসে বিশেষভাবে নফল রোযা রাখা, নফল নামায পড়া অথবা ইতিকাফ করা দ্বীনের মধ্যে সৃষ্ট বিদআতের অন্তর্ভূক্ত।
যারা এ সব করে তারা এমন কিছু হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করে যেগুলো দুর্বল অথবা বানোয়াট।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন: রজব ও শাবানকে মিলিয়ে একসাথে পুরো দুমাস বিশেষভাবে রোযা রাখা অথবা ইতিকাফ করার সম
No comments